ঢাকার ফকিরাপুলের ডিআইটি রোডের একটি ছোট কক্ষে সাখাওয়াত হোসেনের ট্রাভেল এজেন্সির কার্যালয়। অফিসে রয়েছে কেবল একটি টেবিল এবং তিনটি চেয়ার। মাসিক ভাড়া ছয় হাজার টাকা। সাখাওয়াত নিজেও ফকিরাপুলে একটি মেসে থাকেন।
তবুও, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) নথিপত্রে সাখাওয়াতকে কে টেলিকম নামের (যা পরে ইন্টারন্যাশনাল ভয়েস টেল লিমিটেড নামে পরিবর্তিত হয়) একটি ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে (আইজিডব্লিউ) কোম্পানির অংশীদার এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে দেখানো হয়েছে। আইজিডব্লিউর মাধ্যমে বিদেশ থেকে ফোনকল বাংলাদেশে আসে। কে টেলিকমের কাছে বিটিআরসির ১২৬ কোটিরও বেশি টাকার পাওনা রয়েছে। এই টাকার জন্য বিটিআরসি কোম্পানির মালিকদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে।
প্রশ্ন ওঠে, সাখাওয়াত কীভাবে এমন একটি বড় প্রতিষ্ঠানের মালিক হলেন? গত ১৭ ডিসেম্বর ফকিরাপুলে তাঁর কার্যালয়ে গিয়ে তাঁকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, *“আমি নিজেই জানতাম না আমি মালিক। গত ১৮ অক্টোবর বিটিআরসির কর্মকর্তারা রাঙ্গুনিয়া থানার পুলিশ নিয়ে আমার গ্রামের বাড়িতে যান। তখনই আমি এই কোম্পানি এবং আমার মালিকানার বিষয়টি জানতে পারি।”*
কে টেলিকম মূলত নারায়ণগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের পরিবারের মালিকানায় ছিল। ২০১২ সালে শামীম ওসমানের স্ত্রী সালমা ওসমান এবং ছেলে ইমতিনান ওসমানের নামে ১৫ বছরের জন্য কে টেলিকমের লাইসেন্স নেওয়া হয়। এছাড়া, কোম্পানিতে শামীম ওসমানের শ্যালক তানভীর আহমেদ এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী জয়নাল আবেদীন মোল্লা ও জাহাঙ্গীর হোসেন মোল্লারও মালিকানা ছিল।
নথিপত্র অনুযায়ী, ২০১৩ সালের ৪ আগস্ট ওসমান পরিবার কে টেলিকমের মালিকানা সাখাওয়াত হোসেন, সিলেটের স্কুলশিক্ষক দেবব্রত চৌধুরী এবং বগুড়ার অফিস সহকারী রাকিবুল ইসলামের নামে হস্তান্তর করে। তবে এই তিনজনই বলেছেন, তাঁরা এই বিষয়ে কিছুই জানতেন না। তাদের নাম জালিয়াতি করে ব্যবহার করা হয়েছে।
বিটিআরসি ও সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সরকারের পাওনা থেকে বাঁচতে ওসমান পরিবার দ্রুত কে টেলিকমের মালিকানা ওই তিনজনের কাছে হস্তান্তর করে। এ ক্ষেত্রে নকল নথি ও ভুয়া ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। এমনকি সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোও এই প্রক্রিয়ায় সহায়তা করেছে।
জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পর গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর শামীম ওসমান ও তাঁর পরিবার আত্মগোপনে রয়েছেন। শামীম ওসমানের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
বিটিআরসির বিশাল পাওনা
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর টেলিযোগাযোগ খাতে বেশ কিছু লাইসেন্স দেওয়া হয়। তখন বিদেশ থেকে কল আনার ব্যবসা ছিল অত্যন্ত লাভজনক। জাহাঙ্গীর কবির নানক, শামসুল হক টুকু এবং শামীম ওসমানসহ কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা আইজিডব্লিউ লাইসেন্স নেন। লাইসেন্স নিতে হলে ফি দিতে হয় এবং কল থেকে আয়ের একটি অংশ বিটিআরসিকে দিতে হয়।
কিন্তু রাজনৈতিকভাবে লাইসেন্স পাওয়া ব্যক্তিরা বিটিআরসির পাওনা পরিশোধ না করে একপর্যায়ে ব্যবসা বন্ধ করে দেন। এখনো ছয়টি প্রতিষ্ঠানের কাছে বিটিআরসির ৯২১ কোটির বেশি টাকা পাওনা রয়েছে।
বিটিআরসি ২০১৪ সালের ২২ জুন কে টেলিকমের পাওনা আদায়ে মামলা করে। ২০২৩ ও ২০২৪ সালে বিটিআরসি কর্মকর্তারা নতুন ‘মালিকদের’ বাড়িতে যান।
নতুন ‘মালিক’ বগুড়ার রাকিবুল ইসলাম জানিয়েছেন, তিনি কীভাবে এই কোম্পানির মালিক হয়েছেন, তা তিনি জানেন না। তিনি ২০০৬ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ঢাকার সাভারে একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেছেন এবং এখন বগুড়ায় একটি প্রতিষ্ঠানে অফিস সহকারী হিসেবে কাজ করেন। তাঁর ধারণা, তাঁর জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে এই জালিয়াতি করা হয়েছে।
একইভাবে, সিলেটের দেবব্রত চৌধুরীকে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। তবে পরদিন শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কারণে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
মালিকানা স্থানান্তরের প্রক্রিয়া
প্রতিষ্ঠানের মালিকানা আরজেএসসি থেকে স্থানান্তরিত হয়। টেলিকম খাতের জন্য মালিকানা হস্তান্তরে বিটিআরসি এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন লাগে।
বিটিআরসি জানিয়েছে, যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই কে টেলিকমের মালিকানা পরিবর্তনের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। তবে সূত্র বলছে, নথিপত্র যাচাই ছাড়াই অনুমোদন দেওয়া হয়।
বহুমাত্রিক দুর্নীতি